ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কলা ভবন। তিন তলার ক্লাস রুম। সেই রুমে পিন পতন নীরবতা। নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। একজন শুধু কথা বলছেন। একজন অধ্যাপক। শব্দের জালে, কথার জাদুতে মোহিত করে রেখেছেন পুরো ক্লাসরুম। তিনি আর কেউ নন, মনোবিজ্ঞান বিভাগের সম্মানিত অধ্যাপক ড. মেহতাব খানম। শুধু ক্লাসরুমই নয়, কাউন্সেলিং রুমে ক্লায়েন্টের সাথে কথোপকথনও যেন মন ভালো করার ওষুধ। কথার এই জাদুর জন্যই কি তিনি এতটা জনপ্রিয়?
তিনি নিজে কী বলেন? হাসতে হাসতে বললেন, “সবসময় অন্যের মনের কাছে যাওয়ার প্রয়াস নিয়ে কথা বলেছি। যখন আমি শিশুদের সাথে কথা বলি, তারা যে ভাষাটা বুঝবে সেই ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করি। বড়দের সাথে বড়দের মতো করে। সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের সাথে কাজ করেছি। তখনও চেষ্টা করেছি তাদের ভাষায় কথা বলার। তাদের মনের কথা বোঝার। আর সেটা শুরু করেছি সচেতনভাবেই। তবে কাউন্সেলিং প্রশিক্ষণ এখানে একটা বিরাট ভূমিকা রেখেছে। প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ক্লাস রুমে পড়ানোর ধরনটাও পরিবর্তন হয়েছে।”
পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে কেন বেছে নিলেন? বললেন, “শিক্ষকদের প্রতি আমার একটা আলাদা শ্রদ্ধাবোধ ছিল ছোটবেলা থেকেই। পরিবার থেকে শিক্ষকদের শ্রদ্ধা করতে শেখানো হয়েছিল। পড়তে ভালোবাসতাম বলে নিজেও তখন থেকেই শিক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছি। রেজাল্ট ভালো করার জন্য আমাকে কখনো পড়াশুনার কথা বলতে হয়নি। নিজে থেকেই পড়তাম। শিক্ষকতা পেশায় ঢোকার পর ছেলেবেলার সেই স্বপ্ন পূরণ হলো।”
কাউন্সেলিংয়ের প্রতি আগ্রহের বিষয়ে বললেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম কেমিস্ট্রিতে। ভালো লাগেনি। একজন নিকটাত্মীয় বলেছিলেন, মনোবিজ্ঞান পড়লে আমি হয়তো ভালো করব। ভর্তি হলাম মনোবিজ্ঞান বিভাগে। ভালো লাগতে শুরু করল। মাস্টার্সে পড়ার সময় কাউন্সেলিং অ্যান্ড গাইডেন্স একটা কোর্স নিয়েছিলাম। তখন থেকেই কাউন্সেলিং- ভালো লাগত। এরপর শিক্ষক হিসেবে জয়েন করলাম। শুরুতেই আমার ওপর দায়িত্ব পড়লো মাস্টার্সের ক্লাস নেয়ার। পড়াতে হবে কাউন্সেলিং কোর্সটাই। প্রথমেই স্নাতকোত্তর পর্যায়ের স্টুডেন্টদের ক্লাস নিতে একটু ভয়ই লাগছিল। কিন্তু প্রস্তুতি নিয়ে, বিশেষ করে সুলতানা জামান ম্যাডামের উৎসাহে শুরু করলাম। পড়াতে পড়াতে আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। এরপর পিএইচডি ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ। যত গভীরে যেতে শুরু করি তত ভালো লাগে। ধীরে ধীরে মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিংয়ের প্রতি আমার একটা বিশেষ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা তৈরি হলো। আসলে পেশা যখন নেশা হয়ে যায়, তখন সেটার মধ্যে ঢুকে পড়াটা সহজ হয়ে যায়।’’
চলার পথটাও খুব একটা ঝামেলাপূর্ণ ছিল না তাঁর। বহিরাগত বা রাজনৈতিক কোন ঝামেলাই তাঁকে পোহাতে হয়নি। তবে দ্বন্দ্ব ছিল তাঁর নিজের মনের সঙ্গেই। বললেন, “বিষয়টির গভীরে ঢুকে নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য পরিশ্রম করতে হয়েছে ঠিকই। কিন্তু কোথাও থেকে কখনোই কোনো বাধা আসেনি। আর পেশার পেছনে এই যে এতটা সময় দেওয়া, পরিশ্রম করা, সে কারণে পরিবারে সময় দেওয়া হতো না। দ্বন্দ্বটা এখানেই এবং তা একান্তই আমার মনের জগতে।”
আরো বললেন, “সেই দ্বন্দ্বটা তো এখনও চলছে। আমি রাঁধতে ভালোবাসি। বই পড়তে ভালোবাসি। সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করে। অনেক লেখা মাথায় ঘুরঘুর করে। কিন্তু সময়ের অভাবে কিছুই করতে পারি না। অথচ ইচ্ছে তো করে। কিন্তু পেশার কারণে ইচ্ছে বা শখের পেছনে সময়টা দেওয়া হয়ে ওঠে না। সেটাও তো একান্তই নিজের। বহির্জগতের সাথে সেখানে কোনো লেনা-দেনা নেই। যেহেতু আমি আমার কাজটাকে ভীষণ ভালোবাসি, তাই এই কাজের পেছনেই সময় দিই। লেগে থাকি। সিরিয়াসলি কাজটাই করি।”
পেশাগত দায়িত্ব পালনে পরিবার থেকেও সবসময় পেয়েছেন সব ধরনের সাপোর্ট। ‘পরিবারের সকলের সহায়তা পেয়েছি বলেই দেশের বাইরে গিয়ে উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। আমার জীবনসঙ্গীও সবসময় সব কাজে সহায়তা করেছেন। উৎসাহ দিয়েছেন। পার্টনার যদি সাপোর্ট দেয়, অনুভূতিপ্রবণ হয়, তাহলে আসলে অন্য ঝামেলাও কম হয়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।’
“তবে এটা ঠিক এখন কর্মজীবী মায়েদের মানসিক দ্বন্দ্ব আরো বেড়ে গেছে। সন্তান কিংবা কর্ম- যে কোনো একটা তাদেরকে বেছে নিতে হচ্ছে। আর এই দ্বন্দ্ব থেকেই অনেক রকম পারিবারিক ঝামেলা তৈরি হচ্ছে। সরকার বৃত্তি-উপবৃত্তির মাধ্যমে নারী শিক্ষার হার বাড়িয়েছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সুবিধা দিতে পারেনি। সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে যদি কর্মক্ষেত্রগুলোতে, স্কুলগুলোতে ডে-কেয়ারের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে এখনকার মেয়েরা- মায়েরা আরো এগিয়ে যেতে পারত।”
মানসিক স্বাস্থ্যেরও যে যত্ন নিতে হয়, মানুষ তা ধীরে ধীরে বুঝতে শিখছে। ফলে বাড়ছে সাইকো থেরাপিস্টদের চাহিদা। এই সময়ে যদি কেউ সাইকো থেরাপিকে পেশা হিসেবে নিতে চান, তাদের জন্য মেহতাব খানম বললেন, “কাউন্সেলিং নিয়ে এক বছরের মাস্টার্স বা কিছু প্রশিক্ষণ যথেষ্ট নয়। আরো পড়াশোনা দরকার। অন্তত চার বছর এই বিষয় নিয়েই পড়াশোনার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ নিতে হবে। কারণ কাউন্সেলিং প্রশিক্ষণ তো শেষ হওয়ার নয়। মানুষের মনের ভেতরের, অবচেতন মনের খোঁজখবর রাখাটা তো অতটা সহজ নয়। দেশে যা কিছু আছে, তা পর্যাপ্ত নয়। শুধু কাউন্সেলিং অথবা সাইকোথেরাপির ওপর প্রশিক্ষণ দেবার জন্যই দেশে আলাদা ইন্সটিটিউট হওয়া দরকার।”
নারীদের বাইরের সৌন্দর্যটাকে গড গিফটেড বলে মনে করেন মেহতাব খানম। তিনি বললেন, “নারীর সৌন্দর্যের সংজ্ঞাটাও পরিবর্তন হওয়া দরকার। আমি দেখতে যেমনই হই না কেন, আমার আচরণ, কথাবার্তা, নিজেকে উপস্থাপন করা এইসব কিছু মিলিয়েই আসলে একজন মানুষ সুন্দর হয়ে ওঠে। তাই ভেতরের মানুষটির সৌন্দর্য্যের চর্চা করা দরকার। ভেতরটা সুন্দর হলে, তার প্রকাশ বাইরে ফুটে উঠবেই।”
লেখা: সুলতানা স্বাতী
ছবি: রফিকুর রহমান রেকু