ভোজনরসিক অনেকেই আছেন। নতুন নতুন খাবার নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসেন অনেকেই। নিজের রান্না করা খাবার ফেসবুকে শেয়ার করেন কম-বেশি সবাই। বাইরে খেতে গেলেও সেখানকার খাবারের ছবি ফেসবুক/ইনস্ট্রাগ্রামে শেয়ার করেন অনেকেই। কিন্তু ফুড ব্লগিংকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার সাহস কি করেন?
ইফ্রিত তাহিয়া এমনই একজন তরুণী যিনি ফুড ব্লগিংকে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। ইনস্ট্রাগ্রাম ও ফেসবুকে ‘ইফিবিফিস/iffybiffys’ এ খাবার নিয়ে ব্লগিং করেন তিনি। অর্থাৎ নিজের রান্না করা খাবার বা বিভিন্ন জায়গায় খেয়ে এসে তার রিভিউ লেখেন। সাথে ছবিও পোস্ট করেন। খাবারের অজানা দিক সম্পর্কে অন্যদেরকে জানান। বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খাবারের দাম সম্পর্কেও ধারণা দেন।
কথা হচ্ছে, এত পেশা থাকতে ফুড ব্লগিংকেই কেন বেছে নিলেন ইফ্রিত?
বললেন, “ছোটবেলা থেকেই আমি খেতে পছন্দ করি। বাইরে রেস্টুরেন্টের খাবারের প্রতি আমার ছিল অদম্য আকর্ষণ। বাইরে খেতে যাচ্ছি শুনলেই নেচে উঠতাম। আমার ছেলেবেলা কাটে চট্টগ্রামে। ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তখন আমি যেখানে থাকতাম সেখান থেকে ক্যাম্পাসের দূরত্ব ছিল অনেকখানি। ফলে বেশিরভাগ সময়ই বাইরে খেতে হতো। আর নতুন নতুন রেস্টুরেন্টে নতুন নতুন খাবারের স্বাদ নেওয়া তো আমার এক ধরনের প্যাশনই বলতে গেলে। ঐ সময় বাইরে খাওয়া মানেই ছবি তোলা। তখন হঠাৎ আমার মাথায় আসলো, কোন একটি জার্নালে খাবার নিয়ে লিখলে কেমন হয়!”
জার্নালে লিখতে লিখতেই তাহলে ব্লগিংয়ের চিন্তাটা আসে? বললেন, “আসলে বিষয়টি তেমন না।। আমি নিজে কখনো ভাবিনি যে, আমি একজন ফুড ব্লগার হব। বরং আমার আগ্রহ ছিল উন্নয়নমূলক খাতে কাজ করার। সে কারণেই বেশ কয়েকটি উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার যোগাযোগ ঘটে। বিশেষ করে মানবাধিকার, শিশুদের শিক্ষাখাত, নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ ঘটে। সেসময় এরকম একটি প্রতিষ্ঠানে লিডারশিপ ট্রেনিংও করেছিলাম। আর এর ফলেই পেয়ে যাই এক বছর আমেরিকায় পড়াশোনা করার একটা সুযোগ, যার সম্পূর্ণ অর্থায়ন করেছিল সেদেশের সরকার। নারীর ক্ষমতায়ন ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রধিনিধি হিসেবে চীন ও নেপালেও গিয়েছিলাম আমি।
“এ কারণেই জার্নালে লেখালেখির পাশাপাশি আমি কিন্তু আমার উন্নয়নমূলক খাতের কাজটাও চালিয়ে যাই। আর তখন, ২০১৪ সালে আমার একটি প্রোগ্রাম হয় যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারে। তবে ওইসময় ওখানকার আবহাওয়ায় আমি একদমই খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। মন খারাপ থাকত। আমার হোস্ট ছিলেন যে মহিলা; তিনি একজন ফটোগ্রাফার। আবার রান্নায়ও তার ছিল ভীষণ আগ্রহ। তার সাথে থেকে আমিও কিছু রান্না শিখে ফেলি। কিছুটা অন্যরকম সেসব রান্না। আমরা যখনই নতুন কোনো আইটেম রান্না করতাম, তিনি ছবি তুলতেন। সেই ছবিগুলো আবার আমাকে দিতেন, যদি আমি সেগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করতে চাই-সেজন্য। তিনিই আমাকে বলেন, ইন্সট্রাগ্রামে একাউন্ট খুলে ছবিগুলো শেয়ার করতে। ওখানে থাকতেই আমি ইন্সটাগ্রামে একাউন্ট খুলি। নাম দেই iffybiffys. সেই একাউন্টে ছবি ও খাবারের রেসিপিগুলো শেয়ার করি। এভাবেই জন্ম হয় iffybiffys এর।
“তবে তখন কিন্তু অতটা সিরিয়াস ছিলাম না। গত দু’বছর থেকে ফুড ব্লগিং নিয়েই বিশেষ কিছু করার চেষ্টায় আছি। বিশেষ করে ২০১৮ সাল থেকে আমি বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ও তাদের খাবার নিয়ে লেখা শুরু করি। গত দুই বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে এখন iffybiffys একটা প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পেয়েছে।”
হাসতে হাসতে বললেন, “আমার ভাগ্য ভালো যে, আমি মার্কেটিং নিয়ে পড়াশুনা করেছি। ব্লগিং এর ক্ষেত্রে এই সাবজেক্ট আমাকে ভীষণভাবে সহায়তা করেছে। খাবার বা রেস্টুরেন্টকে আমি এমনভাবে উপস্থাপন করি, যাতে সেখানে অনেকেই যেতে আগ্রহী হয়। আর সেটা বাস্তবে হয়ও! এখন তো আমার সাথে অনেক ব্র্যান্ড যোগাযোগ করে। তাদের খাবার নিয়ে ব্লগিং করতে অনুরোধ জানায়। এটাই তো আমার পরম পাওয়া!”
বললেন, “এমনকি করোনায় যখন সব বন্ধ, তখনও কিন্তু অনেকেই আমার বাসায় খাবার পাঠাতো। সেগুলো নিয়ে ব্লগিং এর জন্য। সেসময় অনলাইনে খাবার বিক্রি বাড়াতেও বিভিন্ন জনের অনুরোধ আসতো। গত বছর থেকে তো বাসায় রীতিমত আমন্ত্রণপত্র আসতে শুরু করেছে।’
তবে ব্লগিংকে পেশা হিসেবে নেওয়াটা সহজ ছিল না। বললেন, “এই পেশার সাথে যুক্ত হতে আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন বিশেষভাবে মা। আর বড় বোন। বাবা প্রথম দিকে ভয় পেতেন। আসলে ব্লগিং নিয়েই তো তাদের ধারণা নেই। তার ওপর আবার ফুড ব্লগিং। তবে এখন বাবাও অনেক খুশি।
“এই যে অনেকেরই ব্লগিং সম্পর্কে ধারণা নেই; কাজের ক্ষেত্রে এটাই কিন্তু ছিল আমার বড় বাধা। কী করি? ফুড ব্লগিং। শুনলেই মানুষ চোখ কপালে তুলত। তখন খারাপ লাগত। এখন মনে হয়, বাবা-মা যখন বুঝতে পেরেছে যে এটাকে পেশা হিসেবে নেওয়া যায়, তখন ধীরে ধীরে অন্যরাও বুঝবে।
“আরেকটি বড় বাধাও আমি মোটামুটি পেরিয়ে এসেছি। আসলে এতদিন আমার একাউন্টে বেশিরভাগই খাবারের ছবি থাকত। ২০২০ সাল থেকে খাবারের পাশাপাশি আমি নিজেকেও সামনে আনি। তখন অনেকেই নানা বাজে ও বিব্রতকর মন্তব্য করত। যা আমাকে উদ্বিগ্ন করে তুলত। এখন আমার আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। তাছাড়া এখন ধীরে ধীরে ফুড ব্লগিং জনপ্রিয় হচ্ছে।”
বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সুরেই ইফ্রিত বললেন, “প্রেস্টিজ ম্যাগাজিন বাংলাদেশের টপ এইট ফুড ব্লগারদের নিয়ে স্টোরি করেছিল। ওই ব্লগারদের মাঝে আমার নামটাও ছিল। বিষয়টি ছিল আমার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার।”
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বললেন, ‘ইচ্ছে তো আছে বিভিন্ন দেশ ঘুরে তাদের খাবার সম্পর্কে জানার। আরো বেশি বেশি ভিডিও কন্টেন্ট ও রেসেপি নিয়ে কাজ করার।’
এখন তো অনেকেই ফুড ব্লগিংকে পেশা হিসেবে নিতে চান। তাদের জন্য করণীয় সম্পর্কে বললেন, ‘ফুড ব্লগিং মানেই নামি-দামি রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া নয়। নিজের রেসিপি, নিজের বানানো খাবার দিয়েও শুরু করা যায়। এক্ষেত্রে অন্যের মতামত যতদূর সম্ভব এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। আর লাইক, ফলোয়ার না দেখে জাস্ট খাবারের ছবি শেয়ার করা। তাহলেই শুরুটা হলো।’
লেখা: তাসনিম সারওয়ার রাইসা, সুলতানা স্বাতী
ছবি: মাহ্মুদা তুলি